এস. এম. রায়হান চৌধুরী

আনওয়ারি

গল্প, ছোটগল্প
লেখাটি শেয়ার করুন

এস.এম.রায়হান চৌধুরী

হাতে একটি পশমি রুমাল নিয়ে রাজদরবারে প্রবেশ করলেন আনওয়ারি। রুমালে সুলতান আহমেদ সানজারের নামলিপি (ক্যালিগ্রাফি)। কালি ঢেকে নামের উপর দিয়ে সেলাই ও করা।

উপহার হিসেবে রুমালখানি দিলে সুলতান সানজার হাসিমুখে তা গ্রহণ করেন। সভাকবি আনওয়ারি মাঝেমধ্যেই তাকে নিয়ে কবিতা লিখে। তার বদান্যতা করে। ভালো লাগে তার। বিশেষ করে যখন মন খারাপ থাকে কিংবা মনে কোন দুশ্চিন্তা আসে। এই জন্যই তো তাকে রাখা হয়েছে!

বাঁকানো হরফে নিজের নামে আবার সুতার কাজ দেখে সুলতান মনে মনে আনন্দিত হলেন। তবে, প্রকাশ করলেন না। শুধু একটু মুচকি হাসলেন।

আনওয়ারিকে বললেন, “কী হে, হঠাৎ রুমাল উপহার দিচ্ছো যে? সময় ভালো যাচ্ছে না কি?”

হাসিখুশি মুখটা একটু কালো হয়ে গেল আনওয়ারির। চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ঝড় আসছে হুজুর। বিশাল ঝড়। এই খোরাসান রাজ্যের উপর বিপদ ধেয়ে আসছে।”

সুলতান সানজার কিছুটা চিন্তিত হলেন। আনওয়ারি শুধু কবি নয়, জ্যোতিষও বটে। সাহিত্য, সঙ্গীত, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যামিতি অর্থাৎ যাবতীয় বিজ্ঞানের শাখায় মোটামুটি ভালো দখল আছে তার। তুস শহরের মানসুরিয়া কলেজে পড়াশোনা করেছে। তাই, আনওয়ারির কথায় চিন্তিত না হয়ে উপায় নেই।

“বলো কী? কীরকম ঝড়?”

“সমুদ্রের ঝড়ের থেকেও বিশাল, মরুঝড় থেকেও রুক্ষ এক ঝড় সুলতান। ঠিক এক যুগ পর আজকের এই দিনে ভীষণ এক ঝড় আসবে পৃথিবীতে।”

“এক যুগ পর! তা সময়েরটা সময়ে দেখা যাবে। নতুন কোন কবিতা লিখেছ না-কি?”

একটা কবিতা পড়া শুরু করলেন আনওয়ারি,

‘আপনার নাম ঐ রুমালে গেঁথেছি মানে এই নয় আপনি নেই মনে

আল্লাহ-রাসূলের পরে আপনার নাম জপি সঙ্গোপনে,

রেখেছি তো শ্বাস আপনারি স্কন্ধে-

রেখেছেন যত্নে নিজেকে রাখেন যেমন আতরজলে,

আসিতে চায় ওই ভীনদেশী—আপনার চরণতলে;

থাকিতে চায় আপনার রাজ্যে এই সমরকন্দে!’

মারহাবা বলে উঠলেন সুলতান। সাথে সকল সভাসদ। গলা থেকে মালা খুলে পরিয়ে দিলেন আনওয়ারিকে। তাকে একটি আরবি ঘোড়াও উপহার দিলেন। কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ালো আনওয়ারি।

হুট করেই সভাকবি হয়ে যাননি তিনি। এরজন্য তাকে এক বিশাল ধাঁধার পথ পার হয়ে আসতে হয়েছে। কবিতা লিখে যখন দেখলেন ভাগ্য ফিরছে না—তখন তিনি চলে গেলেন সেই তুস শহরে। পড়াশোনা করতে।

ইদের বন্ধে বাড়ি ফিরে এলেন একবার। বিকেলে বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছেন বালখ্ নদীর ধারে। তার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু তাকে দুঃখের কথা জানালো। সুলতান সানজারের সভাকবি মুয়িজি কীভাবে তার সাথে প্রতারণা করেছে সেই ঘটনা বলল তাকে।

কবি মুয়িজির ছিল মারাত্মক স্মরণশক্তি। একবার কোনকিছু শুনলেই সে তা হুবহু বলে দিতে পারত। এই গুণ তার ছেলের মাঝেও বিদ্যমান ছিল। তার যে চাকর ছিল, তারও ছিল এই অদ্ভুত ক্ষমতা!

এরা কোনকিছু বললে হুবহু মনে রাখত পারত। এই স্মরণশক্তিকে কাজে লাগিয়ে কবি মুয়িজি হয়ে উঠেছিলেন হিংসুটে এবং ঠগ।

রাজদরবারে নতুন কোন কবি এলে তাকে সুলতানের কাছে নিয়ে যেতেন না মুয়িজি। তিনি চাইতেন না নতুন কোনো কবি এসে যেন তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাক!

নতুন কোনো কবি এলে তাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হতো মুয়িজির কাছে। সেখানে কবিত্বের পরীক্ষা হতো। পরীক্ষায় পাশ করলেই কেবল মিলত সুলতানের দেখা। কিন্তু, সেই পরীক্ষায় কখনও কোনো কবি পাশ করত না। অনেক ভালো কবি আসত সেখানে পরীক্ষা দিতে। টিকত না কেউ।

মুয়িজি তেমন ব্যবস্থাই করে রেখেছিল। কোনো কবি এসে কবিতা বললে—মুয়িজি বলত এটা তার কবিতা। স্মরণশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে হুবহু সেই কবিতা বলে যেত। একে একে তার ছেলে এবং চাকরকে দিয়েও বলিয়ে নিতো।

অগত্যা সেসব কবিদের কিছু করার থাকত না। বিচারক বলতেন, এটা মুয়িজিরই কবিতা। এই কবিতা তার ছেলে এবং চাকর দুজনেই জানে।

এভাবে দিনের পর দিন কবিরা মুয়িজির কাছে ঠকে যাচ্ছিল। আনওয়ারিকে তার বন্ধু দুঃখের কথা জানালে আনওয়ারি সিদ্ধান্ত নেয়—এবার সে নিজে যাবে সেখানে।

বলেছিলেন বটে যাবেন, তবে তিনি বিষয়টা ভুলে গিয়েছিলেন দ্রুত। একে ছিল ইদের সময়। তার উপর ঘরের নানারকম কাজকামে বিষয়টা তার মনেই ছিল না।

তিনি যেদিন চলে যাবেন তার আগের দিন দেখলেন, হাতির পিঠে চড়ে কবি মুয়িজি ঘুরছেন। একজন কবির এত অর্থসম্পদ যে হাতির পিঠে চড়ে ঘুরছে! অথচ, তিনি কী ভুলটাই না জানতেন এতদিন। সঙ্গেসঙ্গে একটি ছেঁড়া আলখেল্লা জোগাড় করে গায়ে পরে নিলেন। একপ্রস্ত গড়াগড়ি করে নিলেন ধুলোয়। তারপর চললেন রাজদরবারে।

কবি মুয়িজি এসে শুনলেন এক পাগল এসেছে সুলতানকে কবিতা শোনাতে। তিনি গিয়ে দেখলেন আসলেই পাগল। পাগলটি বলছে,

‘একে রাজা
দুইয়ে রাজা
সবটায় রাজা
আর বাকিসব প্রজা
এই হিসেব তো সোজা।’

আবার বলছে,

‘আমি পাগল
তুমিও পাগল
এই দুনিয়ায়
সবাই পাগল।’

কথার সাথেসাথে আবার হাস্যকর ভঙ্গিও করছে। মুয়িজি খুব মজা পেলেন। মজা হবে ভেবে তিনি পাগলটাকে নিয়ে গেলেন সুলতানের কাছে।

রাজদরবারে ঢুকেই আনওয়ারি ছেঁড়া পোশাকটা খুলে ফেলল। মুয়িজি দেখলেন, কোথায় পাগল! এত একদম সুস্থ মানুষ। ভাঁড়ামিটুকু পর্যন্ত নেই! এরপর সুলতানকে কবিতা শোনানো শুরু করলেন আনওয়ারি। অর্ধেক বলে অবশ্য থেমে গেলেন। তারপর মুয়িজির দিকে তাকিয়ে বললেন, এই কবিতা যদি আপনার লেখা হয়, তবে আপনিই পুরোটা শোনান সুলতানকে। আপনার কবিতা হলে আপনার গলাতেই মানাবে ভালো।”

মুয়িজি মাথা নাড়িয়ে স্বীকার করে নিলেন এটা তার কবিতা নয়।

সুলতান সানজার আনওয়ারির কবিতা শুনে ভীষণভাবে মুগ্ধ হলেন। মুয়িজির আসনে বসালেন তাকে। আর মুয়িজিকে বললেন নিম্নস্থ কবিদের সাথে গিয়ে বসতে।

এমন সময় এক ঘটনা ঘটলো। সুলতানের কথা শোনার পরেও মুয়িজি দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। সুলতানের গেল মেজাজ চড়ে। ছোঁড়া বের করে ছুঁড়ে মারলেন মুয়িজির দিকে। মুয়িজি তা দেখতে পেয়ে সরার চেষ্টা করল বটে তবে পারল না। তার আগেই ছোঁড়া এসে বুকে বিঁধে যায় মুয়িজির। কিছুক্ষণ পরেই মুয়িজির মৃত্যু হয়।

কিছুদিন পরের ঘটনা। সুলতান দেখলেন, আনওয়ারি এখনও হেঁটেই রাজদরবারে আসেন। তিনি আনওয়ারিকে বললেন, “কী ব্যাপার? ঘোড়ার কী হলো? ঘোড়া কি পছন্দ হয়নি?”

“পছন্দ হয়েছে বৈকি। এমন টকটকে রঙের ঘোড়া পছন্দ না হয়ে উপায় কী হুজুর! তবে ও ঘোড়ায় চড়া আমার কর্ম নয়!”

“কেন?”

“আজ্ঞে, এই ঘোড়া এত জোরে ছোটে যে আমি তাল সামলাতে পারি না হুজুর। কোন মানুষই এই ঘোড়ার পিঠে চড়তে পারবে বলে আমার মনে হয় না!”

“আমিও পারব না!”

“না, হুজুর।”

সুলতান রেগে গেলেন। বললেন, “আমার আস্তাবলের ঘোড়া, আর তুমি বলছ—আমি চড়তে পারব না? সাহস তো কম না তোমার, আমার সাথে ইয়ার্কি করছো?”

“তা হলে শুনুন হুজুর—আমি কেন বলছি এ কথা।”

আনওয়ারি একটা কবিতা আবৃত্তি করা শুরু করলেন।

‘কে দেখেছে এমন ঘোড়া, গজনী থেকে গৌড়ে
মর্ত্য থেকে স্বর্গে গেল একটি রাতের দৌড়ে!’

হো হো করে হেসে উঠলেন সুলতান। এবারে আর ঘোড়া নয়, আনওয়ারিকে হাতি উপহার দেওয়া হলো!

সুলতান মারা গেছেন পাঁচ বছর হয়ে গেছে। নতুন সুলতানের দরবারেও সভাকবি আনওয়ারি। একদিন তিনি সুলতানকে বললেন, “হুজুর ঝড় আসছে। পুরো পৃথিবী লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। আর মাত্র তিনদিন!”

তিনদিন পর দেখা গেল ঝড় তো দূরে থাক—আকাশে একটুও মেঘ পর্যন্ত জমেনি। সুলতানের মেজাজ চড়ে গেল। এ কেমন রসিকতা! বিদায় করে দিলেন আনওয়ারিকে।

আনওয়ারির তাতে কিছু যায় আসে না। সে তখন অনেক ব্যস্ত। তিনি বই লিখছেন জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর। সঙ্গীতের উপর, দর্শনের উপর।

পরিণত বয়সে লেখা আনওয়ারির কবিতাগুলো অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য লাগত। কবিতার মতো হেয়ালি করেও কথা বলতেন তিনি। কেউই বুঝতো না সেসব কথার আগামাথা। সুলতানও বোঝেনি। বুঝলে তাকে বিদায় করে দিতেন না। এ কথা সত্য সেদিন কোন ঝড় হয়নি তবে একটি শিশুর জন্ম হয়েছিল। শিশুটির নাম রাখা হয়েছিল, ‘তেমুজিন’!



লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply