সুদীপ ঘোষাল

এক নারী ও রাজার কাহিনী: তৃতীয় পর্ব

উপন্যাস
লেখাটি শেয়ার করুন

সুদীপ ঘোষাল,
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।

 

সন্তু কাজ করতো বি,ডি,ও অফিসে। এই অফিস থেকেই গ্রামের গরীব মানুষরা সরকারী সাহায্য পেয়ে থাকে। তার প্রধান দায়ীত্বে ছিলো সন্তু। গ্রামে গ্রামে গিয়ে লিষ্ট করতো সে। গ্রামের লোকেরা খুব ভালোবাসতো সন্তুকে। কোনোদিন অন্যায়ভাবে কারও কাছে টাকা পয়সা ঘুষ নিতো না সন্তু। একবার রঘু ডাকাত বললো,আমার বাড়ি মিষ্টি, জল খান কেনে। আমি খুশি হবো। সন্তু বললো,আমাকে এক গ্লাস জল দাও। আর কিছু খাবো না। আমি এখন সরকারী কাজ করছি। এর জন্য আমি মাইনে পাই। জামাইমারি গ্রামে একবার সন্তু কাজে গেছিলো। ফিরতে রাত হয়ল গেলো। রাস্তায় দেখলো,অন্ধকারে ঝিনুকঘাটা পুলের তলায় একদল সশস্ত্র লোক। ওরা ডাকাত। কারও হাতে খাঁড়া,কারও হাতে বল্লম, কারও হাতে তীরধনুক। একজন এসে বললো,আংটি কই? সোনার চেনটাও দে। সন্তু বললো,দি,এই নাও। ওদের মাঝে রঘু ছিলো খাঁড়া হাতে। ও এগিয়ে এসে বললো,আরে ঠাকুর মশাই। আপনি। যান, যান কোনো ভয় নাই। দলের লোকদের উদ্দেশ্য করে বললো,তোরা লোক চিনিস না। আমাদের ব্লকের বড়বাবু।
সবাই জোড় হাত করে বললো,মাপ করবেন,আমরা বুজতে পারি লাই গো ঠাকুর মশাই। মদ খেয়ে আচি তো। যান, যান। কুনু ডর লাই। মজা করে হাঁটেন। কুথাও দাড়াবেন নি।

সন্তুর ধড়ে প্রাণ এলো। ঝিনুক ঘাটা পার হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলো। বাড়িতে এসে জল খেয়ে বাঁচলো।

সন্তু মায়ের কাছে শিক্ষা পেয়েছে সততার। তার জন্য আজ সে বেঁচে গেলো। মনে পরছে সন্তুর মায়ের কথা। সে আপন মনেই বলে চলেছে তার মায়ের কথা। মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে দিতে গেয়ে উঠতেন ভক্তিগীত। নিরামিষ মা কালীর আশীর্বাদ মাথায় রেখে ছেলেদের নিয়ে সংসার চালাতেন  ছন্দে। অভাব থাকলেও কোনোদিন তার ছাপ পরেনি মায়ের চোখেমুখে। আসল মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছিলেন পুজোর আসনে বসে। কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো  না  সেসব কথা। তার চলনে, বলনে ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি। মাকে দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের। দাদু মাকে, মা বলেই ডাকতেন। তিনি সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন। মায়ের গান শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে। একবার বৈশাখি ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো। মা বললেন,তোদের দাদুর আত্মা মুক্তি পেলো। অই ডালে বাঁধা ছিলো দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি। অবশ্য এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক। বুড়ি ঠাকুমা সেদিন কেঁদে উঠেছিলো জোরে। ঠাকুমা বলে উঠলেন,চলে গেলো,ও চলে গেলো। কোনো কিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবু কিছু ঘটনা বার বার তার অস্ত্বিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়। একটা দেশি কুকুর আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটে থেকে। তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা,পূর্ণিমায় কিছু খেতো না। রক্ষাকালী পুজোয় উপবাস করতো। তার সামনে খাবার দিয়ে দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না। শুধু কথা বলতে পারতো না। কিন্তু ভাবে, ভঙ্গিমায় সব বেঝাতে পারতো মানুষের মতো। মা বলতেন,পূর্বজন্মে তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো। তাই তোর আমাদের বাড়িতে আগমণ। যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো সারা পাড়ার বাসীন্দা। তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে। কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার সারা জীবন ধরে পালন করা ব্রত,উপবাস। বলবে,কাকতালীয়। সেসব তো এক আধবার হয়। সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয় না।

বিজয়ার সময় আমার মা জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন। ধান রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে জিম আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা। তারপর সাপুড়ে ডেকে  সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড়দার বিছানার মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো। কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পরতো নিঃস্বার্থ ভাবে। প্রত্যেক প্রাণীর কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।

সন্তু ভাবে,মা ছোটো ভাইয়ের কাছে ভালো থাকতো। ভাইরা সবাই ভালো। শুধু আমি হয়তো খারাপ। তাই মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। আর তার দেখা পাবো না। কোন যাদুগর ভ্যানিশ করে কোটি কোটি জীবকে তার আয়ু শেষে। এখন সন্তু চাকরী জীবন থেকে অবসর নিয়েছে। নাতি বড়ো হয়েছে। ছেলের বিয়ে দিয়েছে। নাতনি ঘুরে বেড়ায় বারান্দা জুড়ে। অবসর জীবনে সারা জীবনের ভাবনা এসে জুড়ে যায় হৃদয়ে। তার মনে পরছে বাল্য জীবনের স্মৃতি।

তেঁতুলতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা তেঁতুল।

আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো।
চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা মজা দেখছে আর হাততালি দিচ্ছে।তাল  গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো তাড়ি ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। সকালের তালের রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতেসকালের তালের রস খেতে গেছিলাম। কারণ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তালের রস তাড়িতে পরিণত হয়। মদের মতো নেশা হয়। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সন্ধেবেলায় হাড়ি রসে ভরে যেতো।  ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত।  অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। কোনো পাকামি ছিলো না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো।   আনন্দ ছিলো জীবনে। শয়তানের  বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। হাসি,খুশি সহজ সরল জীবন।

ছোটোবেলার কার্তিক পুজো,গণেশ পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর । সেই ঘরে থেকেই আমরা ভয় দেখাতাম সুদখোর মহাজনকে।সুদখোর ভূতের ভয়ে চাঁদা দিতো বেশি করে। বলতো, তোরা পাহারা দিবি। তাহলে চাঁদা বেশি দেবো।

আমরা পড়তে যেতাম রেল লাইনের ওপাড়ে।

একদিন স্যার পড়াতে পড়াতে অনেক রাত হয়ে গেছে । প্রায় দশটা । বাড়ি ফিরতে হতো লাইনের পাশ দিয়ে ।

চারজনে  ভয়ে ভয়ে লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছি । একটা ট্রেন চলে গেলো বুক কাঁপিয়ে ।

অমাবস্যা র রাতে অন্ধকার হয় শুনেছি । কিন্তু তার থেকেও ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি চারজন ।

হঠাৎ সামনে দেখি গলা থেকে মাথা পর্যন্ত কাটা একটা স্কন্ধ কাটা ভূত ।আমার আর অনুপের  হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে ।

ছোটো থেকেই বিশুর  সাহস বেশী । আমরা ভয়ে বু বু করছি । এমন সময় দেখলাম অনুপকে  কে যেনো ছুঁড়ে পাশের হাই ড্রেনে  ফেলে দিলো ।

বিশু দা হাঁক  দিয়ে বললেন, কে রে ভয় দেখাচ্ছিস । কিন্তু ভূত কোনো সাড়া না দিয়ে থপাস করে বসে পড়লো ।

রতন দা বললেন, কে তুমি, বসে পড়লে কেনো ?

তারপর লাইনের পাথর কুড়িয়ে যেই না মারতে যাবেন তখন ভূতটা কথা বললো ।

বললো,  আমি ভূত নই । আমি মানুষ ।

তারপর আমরা দেখলাম তার আপাদ মস্তক কালো জামা ও প্যান্ট দিয়ে ঢাকা ।

কালো জামার মাঝে সাদা গোল গোল ছাপ । ফলে অন্ধকারে আমরা সাদা ছাপ দেখতে পাচ্ছি কিন্তু আর কিছু দেখা যাচ্ছে না । শুধু দেহ টা ভেসে যাচ্ছে ।

আমি  জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে অনুপকে ছুঁড়ে ফেললো কে ?

জয়া বললো, ভয় পেলে মানুষের আপৎকালীন হরমোন বের হয় । ফলে মানুষ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য লাফিয়ে পড়ে । জয়া পাশের গ্রামের মেয়ে। তাকে আমরা এগিয়ে দিয়ে আসতাম তাদের গ্রামে।

রতনদা বললেন, আর বসে পড়ে লোক টা  পেচ্ছাপ করছিলো ।আর আমরা মনে করেছি ভূত বসে পড়েছে ।

অনুপ ততক্ষণে ড্রেনের কাদা মেখে উঠে আসছে ভূত হয়ে ।

বাড়িতে গিয়ে বলার পরে সবাই  হেসে ফেলেছেন ।
তারপর ভালো মন্দে কেটে যায় সময়।


অপরের ভালো কাজে বাধা দিয়ে একদল বাঁদরের দল মজা পায়। ভালো কাজ দেখলেই তাদের মাথাব্যথা। তারা সমাজের ভালো দেখতে চায় না। কারণ তাহলে তাদের অসুবিধা। গোলেমালে তাদের অনেক কাজ সহজে হয়। গোলমাল পাকাতেই তাদের পাকামি প্রকট করে আনন্দ পায়। পৃথিবীর পাকে তাদের পাকামি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ভালো কাজ কিন্তু চিরদিন অমরত্ব  পেয়ে যায় মানুষের হৃদয়ে।সন্তুর ভাবনার পাশে বসে আছে চিরনবীনের দল।

জয়া দেখে নাতনিকে। আর ভাবে তার ছোটোবেলা ফিরে এসেছে নাতনির রূপ ধরে। এই ভাবেই চিরকাল প্রবাহ চলে জীবনের। সমুদ্রের ঢেউ এর মতো তালে তালে।

এক নারী ও রাজার কাহিনী: তৃতীয় পর্ব


লেখাটি শেয়ার করুন

২ comments

Leave a Reply